ইরানের জনগণ সেই বিপ্লব বিজয়ের আগে থেকেই ফিলিস্তিনের মজলুম জনগোষ্ঠীকে সহায়তা ও পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে আসছে। কিন্তু ইরানে ইসলামী বিপ্লব বিজয়ের মাধ্যমে ইসলামী সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পর ফিলিস্তিনিদের প্রতি সমর্থন ব্যাপক বৃদ্ধি পায়। ইরানের ইসলামী বিপ্লব বিজয় ছিল ইহুদিবাদী ইসরাইলের জন্য চপেটাঘাত। কেননা ইরানের ইসলামী বিপ্লবের রূপকার ইমাম খোমেনী (রহ) কেবল ইরানের জনগণকেই নয় বরং বিশ্বের সকল মুসলমান ও স্বাধীনচেতা মানুষকে আহ্বান জানিয়েছেন ফিলিস্তিনিদের সাহায্যে এগিয়ে আসার জন্য। ইমামের ওই ডাকে সাড়া দিয়ে প্রতি বছর রমজানের শেষ শুক্রবার বিশ্ব কুদস দিবস পালিত হয়। ইমাম খোমেনী ইসরাইলকে মধ্যপ্রাচ্যের বুকে বিষাক্ত টিউমার বা ক্যান্সার বলে অভিহিত করেছেন।
বিশ্ববাসী বিশেষ করে মুসলিম বিশ্ব ইমামের এই আহ্বানে ব্যাপক সাড়া দেয় এবং এই দিনকে কুদস দিবস হিসেবে পালন করতে থাকে। এই দিনে বিশ্বজুড়ে জনগণের এই ঐক্যবদ্ধ কর্মসূচি ফিলিস্তিনিদের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে জাগ্রত রাখা এবং ইহুদিবাদী ইসরাইলের প্রতি বিশ্ব মুসলমানের ঘৃণা প্রকাশের মাধ্যমে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে আমেরিকার পূর্ণ সমর্থন নিয়ে দখলদার ইসরাইল পূর্ব বায়তুল মোকাদ্দাসের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালাচ্ছে। ইসরাইল গাজার নারী, পুরুষ ও শিশুদের ওপর যে নৃশংস হত্যাকাণ্ড চালাচ্ছে তা তারা গত সাত দশক ধরে চালিয়ে আসছে। অথচ জাতিসংঘের ঘোষণা অনুযায়ী আগ্রাসীদের মোকাবেলায় অস্ত্র ধারণা করার অধিকার ফিলিস্তিনিদের রয়েছে। বর্তমানে আমেরিকা 'ডিল অব দ্যা সেঞ্চুরি' নামে নতুন ষড়যন্ত্রমূলক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে ফিলিস্তিনিদের আসল পরিচয় অর্থাৎ বায়তুল মোকাদ্দাসের পরিচিতি ধ্বংসের চেষ্টা করছে যাতে ফিলিস্তিনিদের আর কিছুই অবশিষ্ট না থাকে।
সবচেয়ে দুঃখজনক হচ্ছে, ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ইসরাইল-মার্কিন ষড়যন্ত্রে নতুন করে যোগ দিয়েছে সৌদি আরব। সৌদি-ইসরাইল সম্পর্ক এতদিন গোপন থাকলেও এখন তা প্রকাশ্যে এসেছে। সৌদি আরবের সাবেক সামরিক কমান্ডার জেনারেল আনোয়ার এশকি বলেছেন, তার দেশ ইসরাইলি দখলদারিত্বের মুখে ফিলিস্তিনিদের রক্ষা করতে বাধ্য নয়।" তিনি বিবিসিকে দেয়া সাক্ষাতকারে বলেছেন, "ফিলিস্তিনিদের রক্ষার বিষয়ে সৌদি আরবের বাড়তি কোনো দায়িত্ব নেই। ফিলিস্তিনিরা যেহেতু সৌদি নাগরিক নন সে কারণে রিয়াদের কাছ থেকে সুরক্ষা পাওয়ার অধিকার তারা রাখেন না।" তিনি বলেন, "ইসরাইলকে অযথা শত্রু ভাবা হয়।”
কিন্তু ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রতিষ্ঠাতা মরহুম ইমাম খোমেনি দখলদার ইসরাইলের ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র ও মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার লক্ষ্য উদ্দেশ্য সম্পর্কে ভালোভাবেই অবহিত ছিলেন। বিশ্ব কুদস দিবস পালন সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন, "কুদস দিবস কেবল ফিলিস্তিনিদের দিবস নয়। এটি এমন এক দিবস যে, বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোকে এটা বুঝিয়ে দেয়া, তারা আর কোনো মুসলিম ভূখণ্ডকে গ্রাস করতে পারবে না।"
ইরানের বর্তমান সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী বলেছেন, "ফিলিস্তিনিদের রক্ষা করা সব মুসলমানের দায়িত্ব।" তিনি বলেন, ইয়েমেন, পশ্চিম এশিয়া ও আফ্রিকায় চলমান রক্তাক্ত সংঘাতের মূল কারণ হচ্ছে, অভিন্ন শত্রুর মোকাবেলায় নিজেদের মধ্যকার অনৈক্য এবং নিজেরা ঝড়গা বিবাদে লিপ্ত থাকা। ফিলিস্তিন আজ মুসলমানদের প্রধান সমস্যা যাদেরকে নিজ মাতৃভূমি থেকে বের করে দেয়া হয়েছে।'
প্রকৃতপক্ষে, বিশ্ব কুদস দিবস পালন ঘোষণার পেছনে ইরানের উদ্দেশ্যই হচ্ছে মজলুম ফিলিস্তিনিদের প্রতি আন্তর্জাতিক সমর্থন বজায় রাখা, পশ্চিম এশিয়ায় শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা এবং এ অঞ্চলে আমেরিকা ও ইসরাইলের আধিপত্যের অবসান ঘটানো। ইরান মনে করে, ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরাইলি দখলদারিত্বের অবসান ঘটানো, তাদের অধিকার বাস্তবায়ন করা, বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা শরণার্থীদেরকে মাতৃভূমিতে ফিরিয়ে আনা, বায়তুল মোকাদ্দসকে রাজধানী করে এবং মুসলমান, খ্রিস্টান ও ইহুদিদের নিয়ে মূল ফিলিস্তিনিদের অংশগ্রহণে অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে স্বাধীন ফিলিস্তিন সরকার গঠন করা ছাড়া পশ্চিম এশিয়ায় শান্তি আসবেনা।
এই নীতির আলোকে ইরান দখলদার ইসরাইলের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনি সংগ্রামীদের প্রতি সর্বাত্মক সমর্থন দিয়ে আসছে। ইরানের সংবিধানেও এ বিষয়ে স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে।
ফিলিস্তিনের হামাস আন্দোলনের নেতা ইসমাইল হানিয়া ইরানের সর্বোচ্চ নেতার কাছে লেখা চিঠিতে ফিলিস্তিনিদের প্রতি সমর্থন দেয়ার জন্য সর্বোচ্চ নেতার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। এর জবাবে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা বলেছিলেন, ফিলিস্তিনিদের প্রতি পূর্ণ সমর্থন দেয়া অব্যাহত থাকবে। তিনি বলেন, 'অধিকার হারা ও নিজ মাতৃভূমি থেকে বিতাড়িত ফিলিস্তিন ইস্যু কখনোই ভুলে যাওয়ার মতো নয়। ইসরাইল বিরোধী প্রতিরোধ সংগ্রাম এখন অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেগবান হয়েছে। আমরা কখনোই ইসরাইলকে তার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে দেব না।'
বাস্তবতা হচ্ছে, ইসরাইল ও আমেরিকার অন্যায় কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সমাজের নীরবতা গোট মানব সমাজের জন্যই ক্ষতিকর।
মার্কিন নেতৃত্বাধীন সাম্রাজ্যবাদী শক্তি নয়া মধ্যপ্রাচ্য গঠনের যে পরিকল্পনা তুলে ধরেছে এবং তারা যে প্রক্সি যুদ্ধ শুরু করেছে তা সফল হলে মুসলিম দেশগুলো খণ্ড বিখণ্ড হয়ে যাবে। আমেরিকা ধর্ম, বর্ণ ও জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে এ অঞ্চলের জাতিগুলোর মধ্যে সংঘাত বাধানোর চেষ্টা করছে যাতে পশ্চিম এশিয়াসহ গোটা মুসলিম বিশ্বের ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা যায়। এসব কারণে ইরান মনে করে ফিলিস্তিন সংকট বর্তমানে মুসলমানদের প্রধান সংকট এবং তাদেরকে রক্ষার দায়িত্ব বিশ্বের সব মুসলমানের।
ইহুদিবাদী ইসরাইলের নির্যাতনের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে যে, আলোচনার মাধ্যমে তাদেরকে কখনোই দমানো যায় নি বরং কুদস দিবস পালন কিংবা মুসলিম দেশগুলোর ঐক্যবদ্ধ চাপের মাধ্যমে তাদেরকে কিছুটা দমানো সম্ভব হয়েছে। এবারের বিশ্ব কুদস দিবস ইসরাইল ও তাদের মিত্রদের জন্য এ বার্তাই পৌঁছে দেবে যে, ফিলিস্তিনের ওপর দখলদারিত্ব ও জুলুম নির্যাতনের দিন শেষ হয়ে এসেছে। সারা বিশ্বের মুসলমানদের উচিত মুসলমানদের প্রথম কেবলা আল আকসা উদ্ধারে বিশ্ব কুদস দিবসে শরীক হওয়া যাতে ইসরাইলের দখল থেকে ফিলিস্তিন ভূখণ্ড উদ্ধারকে আরো তরান্বিত করা যায়।
সূত্র:parstoday